শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৭:২৫ অপরাহ্ন

শিগগির প্রত্যাহার হচ্ছে না র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা

শিগগির প্রত্যাহার হচ্ছে না র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা

স্বদেশ ডেস্ক:

‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এই বাহিনীর ছয় কর্মকর্তার ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিগগির প্রত্যাহার হচ্ছে না। নানা উদ্যোগ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সিরিজ আলোচনা হলেও তেমন সুফল মেলেনি। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারকে জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া বলে মনে করছে ঢাকা। এজন্য আলোচনা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আইনি পথে হাঁটার সিদ্ধান্তও নিয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে সে দেশে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার।

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান, গত চার মাসের র‌্যাবের কর্মকাণ্ড ও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নকে ইতিবাচকভাবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে র‌্যাবের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য দীর্ঘ প্রক্রিয়া পার হতে হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন।

গত ৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র ‘নিরাপত্তা’ সংলাপে র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার বিষয়ে আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার বিষয়টিকে একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং এর সঙ্গে অনেকগুলো স্টকহোল্ডার জড়িত বলে জানানো হয়।

সূত্র জানায়, বৈঠকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে র‌্যাবের অপরিহার্যতার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানান পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। একই সঙ্গে র‌্যাবের কোনো সদস্য অপরাধে যুক্ত হলে তার যথাযথ বিচারের ব্যাপারেও নিশ্চয়তা দেন।

এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘ওয়াশিংটনের নিরাপত্তা সংলাপে আমরা র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি আলোচনা করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের তরফে এটি সময়সাপেক্ষ ও প্রত্যাহার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ বলে জানানো হয়। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে একটু সময় লাগবে। এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রে আমরা আইনি পথেই যাব।’

এর আগে গত ৪ এপ্রিল ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিøনকেনের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। সেখানে তিনি র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা করেন। এর আগে তিনি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চেয়ে বিøনকেনকে চিঠিও পাঠান। ৪ এপ্রিল বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা ছিল। এটা ওদের প্রসেসে আছে। এটা আমাদের কমপ্লিট করতে হবে। এতে সময় লাগবে। সুইচের মতো না যে একদিনে অন আর অফ করতে পারবে।’

বাংলাদেশে অনেক কিছু সহজে করা গেলেও যুক্তরাষ্ট্রে সেভাবে করা যায় না মন্তব্য করে মোমেন বলেন, ‘আমাদের দেশের সরকার ইয়েস বললে ইয়েস হয়ে গেল। ওখানে অনেক সময় চাইলেও পারে না।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেমন ট্যারিফ প্রত্যাহারের জন্য ২৩টা কমিটিতে অনুমোদন লাগে। তার পর প্রেসিডেন্ট সেটার ওপর রেসপন্স দিতে পারেন। এর আগে প্রেসিডেন্ট কিছু বলতে পারেন না।’

গত ২০ মার্চ ঢাকায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অংশীদারত্ব সংলাপ হয়। বৈঠকে র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছি এবং সন্ত্রাসবাদ ও আন্তর্জাতিক অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছি। শুধু ব্যাখ্যাই করিনি, আমরা এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য উন্মুখ-এটা প্রকাশ করেছি। আশা করছি সামনে সুফল আসবে।’

অংশীদারত্ব সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড। তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আমরা চুপ থাকতে পারি না। যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকারকে সবসময়ই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি অনেক জটিল। এ বিষয়ে আরও কাজ করার আছে।’

এদিকে জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট (জিসোমিয়া) অর্থাৎ সামরিক সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তি সই করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই চুক্তি সইয়ের পাঁচ ধাপের মধ্যে তিনটি ধাপ ইতিমধ্যেই পার হয়েছে। এই চুক্তি সম্পন্ন হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র কিনতে পারবে বাংলাদেশ। গত ২০ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত অংশীদারত্ব সংলাপে জিসোমিয়া চুক্তির খসড়া বাংলাদেশকে দেওয়া হয়। ৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত দুই দেশের নিরাপত্তা সংলাপে জিসোমিয়া চুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া বাংলাদেশের কাছে সুলভ মূল্যে সমরাস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রয়োজনে এ জন্য ঋণ সহায়তার প্রস্তাবও দিয়েছে তারা।

যদিও মার্কিন অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র উচ্চমূল্যের কারণে এক ধরনের অনীহা ছিল বাংলাদেশের। যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার আগে সে কথা বলেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, সাশ্রয়ী মূল্যে বাংলাদেশের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব প্রমাণ করে, এ অঞ্চলে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করছে।

জিসোমিয়া চুক্তির ব্যাপারে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘জিসোমিয়া একটি প্রক্রিয়া, এ চুক্তির জন্য পাঁচটি ধাপ পার হতে হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে তৃতীয় ধাপে রয়েছে। ৭৭টি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জিসোমিয়া চুক্তি সই করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি। এরপর চতুর্থ ধাপে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি প্রতিনিধিদল এসে বাংলাদেশের ক্রয় সংক্রান্ত যে বিধি-বিধানগুলো রয়েছে, তা পরীক্ষা করে দেখবে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে বছরখানেকের মতো সময় লাগবে।’

গত ৬ এপ্রিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে অষ্টম নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সূত্র বলছে, গত ২০ শে মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক ফোরাম ‘পার্টনারশিপ ডায়ালগ’-এ মার্কিন নিরাপত্তা সরঞ্জাম সাশ্রয়ী মূল্যে বাংলাদেশ পেতে পারে এমন ইঙ্গিত মিলেছিল। ৬ এপ্রিলের নিরাপত্তা সংলাপে এ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পায় ঢাকা। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের আর্মস কন্ট্রোল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি আন্ডার সেক্রেটারি বনি ডেনিস জেনকিনস।

এছাড়া বৈঠকে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা সহযোগিতা, সামরিক প্রশিক্ষণ, সমুদ্রে নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা বাণিজ্য ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, রোহিঙ্গা ইস্যু, জঙ্গিবাদ দমন, নাগরিক নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা করে দুই দেশ। এছাড়া মার্কিন অগ্রাধিকার প্রকল্প ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে (আইপিএস) বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। আইপিএস বিষয়েও নতুন প্রস্তাব পেয়েছে ঢাকা। এজন্য নতুন অর্থনৈতিক বিশেষ প্যাকেজও আসছে।

মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড ঢাকায় ২০ মার্চের অংশীদারত্ব সংলাপ শেষে বলেছিলেন, আইপিএসে অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত উপাদান রয়েছে। এই উদ্যোগের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যুক্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র খুশি হবে। আইপিএসের মাধ্যমে সমুদ্রপথে অবাধে ও নিরাপদে পণ্যের সরবরাহের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব বলেছিলেন, আইপিএস-এর অর্থনৈতিক উপাদানে বেশি জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ। আইপিএস যেন কোনো পক্ষকে প্রতিহত করার জন্য না হয়, সেই নিশ্চয়তা চাইছে ঢাকা।

জানা গেছে, মার্কিন প্রতিনিধিরা নিরাপত্তা সংলাপে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ভ‚মিকার ভ‚য়সী প্রশংসা করেছেন। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য সব সহযোগিতার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে সাধুবাদ জানায় বাংলাদেশ। সামনের দিনে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ আহŸান জানিয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের ভ‚মিকার প্রশংসা করে যুক্তরাষ্ট্র।

এছাড়া বৈঠকে ঢাকা-নিউইয়র্ক সরাসরি ফ্লাইট দ্রæত চালু ও অ্যাভিয়েশন খাতের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করে দুপক্ষ। আগামী নবম নিরাপত্তা সংলাপ ২০২৩ সালে বাংলাদেশে হবে বলে বৈঠকে নির্ধারিত হয়। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সক্রিয়। তারা বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। দুই-এক দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের দুটি দল বাংলাদেশ সফরে আসছে। তারা ভাসানচর সফরে যাবেন। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকে ভাসানচরের বিরোধিতা করে আসছিল।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877